তিনশোর্ধ্ব রানের আধুনিক ওয়ানডেতে হয়তো কথাটা বেমানান। তবে রানাসিংহে প্রেমাদাসা স্টেডিয়ামের ক্ষেত্রে তা নয়। সাম্প্রতিক অতীতের কারণেই ওয়ানডেতে কলম্বোর এ মাঠ ২৪৪ রানকেও নিরাপদ দাবি করতে পারে।
শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে কাল প্রথম ওয়ানডের হারে অবশ্য বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের এই যুক্তির আড়াল নেওয়ার সুযোগ নেই। গতকাল বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা দুই দলের অধিনায়কই বলেছিলেন, প্রেমাদাসার উইকেট এবার ব্যাটিংয়ের জন্য ভালো হবে। তাঁদের কথা ভুল মনে হয়নি আজ। নইলে বাংলাদেশের সব ব্যাটসম্যান মিলে যেখানে ১৬৭ রান করে ৭৭ রানে ম্যাচ হারলেন, সেই উইকেটেই কীভাবে সেঞ্চুরি করেন শ্রীলঙ্কার অধিনায়ক চারিত আসালাঙ্কা, বাংলাদেশ ওপেনার তানজিদ হাসানই–বা কীভাবে ৫১ বলে ফিফটি করে খেলেন ৬২ বলে ৬১ রানের ইনিংস!
প্রেমাদাসার উইকেটে পরে বোলিং করা স্পিনারদের সাহায্য পাওয়া নতুন কিছু নয়। তাই বলে এমন খেলতে না পারার মতো বোলিংও হয়নি যে ও রকম লেজেগোবরে ব্যাটিং হবে।
ব্যাটিং দেখে বরং মনে হয়েছে ব্যাটসম্যানরা কোনো অজানা আতঙ্কে ভুগছিলেন, অথবা পাচ্ছিলেন ‘ভূতের’ ভয়। প্রেমাদাসা স্টেডিয়ামের সাম্প্রতিক অতীতের ‘ভূত’। হয়তো তাঁরা ধরেই নিয়েছিলেন, ‘এ মাঠের সর্বশেষ কিছু ম্যাচে শ্রীলঙ্কা এ রকম রান করেও জিতেছে। পরে ব্যাট করা দল সেসব ম্যাচে ভেঙে পড়েছে। ২৪৪ রান তাহলে জেতার মতোই স্কোর! আমরা নিশ্চয়ই হেরে যাব!’ কাজেই উইকেট দিয়ে আসো।
গত ফেব্রুয়ারি মাসে এ মাঠে ২১৪ রান করেও অস্ট্রেলিয়াকে ৪৯ রানে হারিয়েছিল শ্রীলঙ্কা। গত বছর আগস্টে তার আগের সিরিজে ভারতের বিপক্ষে দুই ম্যাচ জিতেছিল ২৪০ আর ২৪৮ রান করে। সর্বশেষ এই দুই সিরিজের চার ম্যাচে টসে জিতে আগে ব্যাটিং নিয়ে জিতেছে শ্রীলঙ্কাই এবং সেটা ও রকম কম রান করে। বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের আতঙ্কিত ব্যাটিংয়ের সৌজন্যে সেই ধারাবাহিকতায় লঙ্কানরা কাল যোগ করে নিল আরেকটি সাফল্য।
স্কোরকার্ড দেখলে মনে হবে সেই ম্যাচগুলোর মতো কালও শ্রীলঙ্কার স্পিনাররাই দাপট দেখিয়েছেন। বাংলাদেশের ১০ উইকেটের ৮টিই স্পিনারদের দখলে, কৃতিত্ব তো তাঁদের দিতেই হবে। কিন্তু সেগুলোর কয়টি শ্রীলঙ্কান স্পিনারদের কৃতিত্বে আর কয়টি বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের আত্মবিসর্জনে, সিরিজের বাকি দুই ম্যাচে ভালো কিছু চাইলে দলের মধ্যে সেটা নিয়ে খোলামেলা আলোচনা হওয়া দরকার।
২৯ রানে অভিষিক্ত ওপেনার পারভেজ হোসেনের বিদায়ের পর দ্বিতীয় উইকেটে তানজিদ ৭১ রানের জুটি গড়েন নাজমুল হোসেনকে নিয়ে। কিন্তু ১৭তম ওভারে দুই রান নিতে গিয়ে নাজমুলের (২৩) রান আউট ভয়াবহ বিপর্যয়ে ফেলে দেয় বাংলাদেশকে। দলের ঠিক ১০০ রানে তাঁর বিদায়ের পর ১০৫ রানের মধ্যে ফিরে যান লিটন দাস, তানজিদ, তাওহিদ হৃদয়, মিরাজ, তানজিম ও তাসকিন। নাজমুল থেকে তাসকিন—মাত্র ৫ রানের মধ্যে পড়েছে ৭ উইকেট! ১৭ থেকে ২১ ওভার পর্যন্ত প্রতি ওভারেই আউট হয়েছেন কেউ না কেউ, ২১তম ওভারেই দুজন। জাকের আলীর ৬৪ বলে ৫১ রানের ইনিংসটা তাই ব্যবধান কমানো ছাড়া আর কিছু করতে পারেনি।
শ্রীলঙ্কার ৪৯.২ ওভারের ইনিংসে অধিনায়ক চারিত আসালাঙ্কার সেঞ্চুরিই ছিল প্রাণ। বিপরীতে ছিল চোট কাটিয়ে চার মাসের বেশি সময় পর মাঠে ফেরা তাসকিনের ৪ উইকেট। আরেক পেসার তানজিমও নিয়েছেন ৩ উইকেট। নিয়ন্ত্রিত বোলিংয়ে ১ উইকেট করে নিয়ে অভিষিক্ত বাঁহাতি স্পিনার তানভীর ইসলাম, এমনকি বিকল্প ষষ্ঠ বোলার নাজমুল হোসেনও হতাশ করেননি।
বাংলাদেশ ম্যাচটা খেলতে নেমেছিল তিন পেসার আর দুই স্পিনার নিয়ে। তাসকিন, তানজিম আর মোস্তাফিজুর রহমানের সঙ্গে দুই স্পিনার মিরাজ ও তানভীর। ব্যাটিং উইকেটেও ব্যাটসম্যান বাড়িয়ে খেলার নীতি যে দলে ষষ্ঠ বোলারের ঘাটতি রেখে দিল, বাংলাদেশের জন্য সেটার যন্ত্রণাবিদ্ধ উপলব্ধি হতে পারত এই ম্যাচে।
তানভীরকে তাঁর দ্বিতীয় ওভারের সময়ই পায়ের সমস্যায় ভুগতে দেখা গেছে। পরে বোলিং চালিয়ে গেলেও নিজের অষ্টম ওভারে বাঁ পায়ে ব্যথা পেয়ে লুটিয়ে পড়লেন উইকেটে। উঠে আবার বোলিং করে ১০ ওভারের কোটা পূরণ করলেও শেষ তিন ওভার বোলিং করেছেন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে।
পায়ের মাংসপেশিতে টান পড়েছিল পেসার মোস্তাফিজেরও। নিজের সপ্তম ওভার বোলিং করতে এসেও তাই করতে পারেননি। ফিজিও বায়েজিদুল ইসলাম তাঁকে মাঠের বাইরে নিয়ে যান। মোস্তাফিজ পরে আবার মাঠে ফিরলেও তাঁকে আর বোলিংয়ে আনেননি অধিনায়ক মিরাজ। সেটার দরকারও হয়নি; কারণ বিকল্প ষষ্ঠ বোলারের কাজটা নাজমুল শুধু ভালো চালিয়েই নেননি, দিয়েছিলেন গুরুত্বপূর্ণ এক ব্রেক থ্রুও।
৩২তম ওভারে বল হাতে নিয়ে চতুর্থ বলেই লিয়াঙ্গেকে লং অনে তানজিমের ক্যাচ বানিয়ে ভাঙেন আসালাঙ্কার সঙ্গে তাঁর জমে ওঠা জুটি। ৮৯ রানে ৪ উইকেট হারিয়ে ফেলা শ্রীলঙ্কাকে পথে ফিরিয়েছিল তাদের পঞ্চম উইকেট জুটিতে আসা ৬৪ রানই। ১০৬ রান করে নবম ব্যাটসম্যান হিসেবে ফেরা আসালাঙ্কাকে এরপর আর খুব বড় সঙ্গ কেউই দিতে পারেননি।
তাতেই–বা সমস্যা কী! প্রেমাদাসা স্টেডিয়ামের সাম্প্রতিক অতীত তো শ্রীলঙ্কার সঙ্গেই আছে! যে অতীত কাল অনেকটা ভূত হয়েই চেপে বসেছিল বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের কাঁধে।
Post a Comment