অতঃপর জয়াসুরিয়াই ব্যাট ধরলেন বাংলাদেশের হয়ে!
গতকাল সকাল সোয়া ১১টা। স্থান কলম্বোর সিনামন গ্র্যান্ড হোটেল। এই হোটেলেই আছে বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কা দল। আগের রাতে প্রেমাদাসায় ঘটে যাওয়া ৫ রানে ৭ উইকেট হারানোর কাণ্ডের পর বাংলাদেশ দলকে দেখার উদ্দেশ্যেই সিনামন গ্র্যান্ডে যাওয়া।
বাণিজ্যিক হোটেল, অত সকালেও বিশাল লবিতে বেশ ভিড়। কফি শপের একটা টেবিল দখলে নিয়ে দিনভর পর্যবেক্ষণে বসে এক সনাৎ জয়াসুরিয়াকেই শুধু পাওয়া গেল, যিনি বাংলাদেশের অমন ব্যাটিং ধসকে ‘স্রেফ একটি দুর্ঘটনা’ বলছেন।
টিম হোটেলে কিছু নজরদারি থাকে, বিশেষ করে সংবাদকর্মীদের প্রবেশাধিকারের ব্যাপারে। তবে শ্রীলঙ্কায় এখনো তেমন সমস্যা হয়নি।
তবে আগের রাতে প্রেমাদাসায় লেজেগোবরে করে আসার পর হোটেল কর্তৃপক্ষকে যদি টিম বাংলাদেশ কানে কানে কিছু বলে থাকে, অতীতে এমন হয়েছে! না, ঢুকতে কোনো বাধার মুখোমুখি হতে হয়নি। তবু সতর্কতা হিসেবে কফি নিয়ে বসে পড়া লবিতে।
বসতে না বসতেই দেখা গেল, লিফট থেকে বেরোচ্ছেন প্রধান নির্বাচক গাজী আশরাফ হোসেন। তাঁর পেছন পেছন হেড কোচ ফিল সিমন্স, জ্যেষ্ঠ সহকারী কোচ মোহাম্মদ সালাউদ্দিন ও বাংলাদেশের টি-টোয়েন্টি অধিনায়ক লিটন দাস।
একটা মিটিং রুম আছে বাংলাদেশ দলের। কিন্তু সেটির বৈদ্যুতিক ব্যবস্থা বিকল থাকায় তাঁরা নেমে এসেছেন লবিতে। কফি শপের সামনেই বসার অভিপ্রায় ছিল। কিন্তু সংবাদকর্মীর নাকের ডগায় বসে টি-টোয়েন্টি সিরিজের দল নির্বাচনী সভা করা ঠিক হবে না ভেবেই কি না, পাশের এক্সিকিউটিভ লাউঞ্জের কোলাহলমুক্ত পরিবেশে ঢুকে পড়েন তারা।
অন্য দিন হলে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে আসন্ন টি-টোয়েন্টি সিরিজের সম্ভাব্য দল জানার জন্য নানা কৌশল অবলম্বন করতেন সংবাদকর্মীরা।
কিন্তু ৫ রানে ৭ উইকেটের ঝটকায় দূরের ভবিষ্যৎ জানার আগ্রহ দেখা গেল না বাংলাদেশ থেকে শ্রীলঙ্কায় উড়ে আসা মিডিয়া কন্টিনজেন্টের। উৎসুক চোখ খুঁজছে বাংলাদেশ দলের সদস্যদের ঝড়ের পর তাঁদের কার কী প্রতিক্রিয়া তা জানতে।
জানার অবশ্য সুযোগ নেই। কারণ সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে আগেই। তাতে ‘হাই’, ‘হ্যালো’র বেশি কারোর সঙ্গে কথা বলার সুযোগ নেই। এমনকি প্রধান নির্বাচক গাজী আশরাফও সৌজন্যের সীমানা পেরিয়ে প্রথম ওয়ানডের বিশ্লেষণে ঢুকতে চাননি।
অবশ্য বলার মতো অবস্থায়ও তিনি নেই। টেস্টে এনামুল হকের অন্তর্ভুক্তি, দুই ওপেনার নিয়ে স্কোয়াড ঘোষণা। ওদিকে ওয়ানডেতে মুশফিকুর রহিম ও মাহমুদ উল্লাহর অভাব চুকাতে বিভীষিকাময় সাম্প্রতিক অতীত সত্ত্বেও লিটন দাসকে মিডল অর্ডারে খেলানো- ব্যাপক ট্রল আর মিম বানানো হচ্ছে গাজী আশরাফকে নিয়ে।
এদিকে শ্রীলঙ্কার কোচ সনাৎ জয়াসুরিয়া লবিতে নেমে এসেছেন। কিছু পরে প্রথম ওয়ানডের বাইরে থাকাদের নিয়ে অনুশীলনে যাবেন। চলমান সিরিজের সবচেয়ে বড় তারকা তিনি। তাই ইন্টারভিউয়ের জন্য জয়াসুরিয়াকে ধরা। তিনি সদয় সম্মতিও দিলেন। তবে সেটি দেবেন বিকেলে।
সে প্রসঙ্গে পরে আসা যাবে। কিন্তু মনে একটা খটখটানি, জিতেও শ্রীলঙ্কা দল অনুশীলনে যাচ্ছে অথচ বাংলাদেশ দল পূর্ণদিবস ছুটিতে! এমন ছুটির দিনেও টি-টোয়েন্টি দলসংক্রান্ত আলোচনার সূত্রে কোচ, অধিনায়ক ও নির্বাচক ছাড়া বাংলাদেশ দলের কাউকে লবিতে নামতে দেখা যায়নি। তবে দুপুরের দিকে শামীম হোসেনকে বের হতে দেখা গেছে। আর বিকেলের দিকে দীর্ঘসময় তাসকিন আহমেদের সঙ্গে লবিতে বসে বৈঠক করেছেন ফিল সিমন্স। তারও একটু পরে একে একে নেমে আসেন বাকিরা। লাইন ধরে তাঁদের অভিন্ন গন্তব্যে যাওয়া দেখে মনে হচ্ছিল, সম্ভবত দলীয় কোনো সভা আছে।
এই আসা-যাওয়ার মুখে তাঁদের ‘থট রিডিং’ কঠিন। কাউকে তেমন উচ্ছ্বসিত দেখায়নি। আবার চিন্তাক্লিষ্ট কি না, সেটিও বোধগম্য নয়। তবে চারদিকে ফিসফাঁস শোনা যাচ্ছে প্রধান কোচ সিমন্সকে ঘিরে। ক্যারিবীয় এই সাবেক ক্রিকেটার অতি সজ্জন। কিংবা তাঁর কোচিং দর্শনে ছাত্রের কান মলে দেওয়ার চর্চা নেই। সিমন্সের এই নরমসরম কোচিং পদ্ধতি সম্ভবত পছন্দ হচ্ছে না দলসংশ্লিষ্টদের। নাকি সিমন্স নরম থাকছেন আর ‘গরম’ দিচ্ছেন সালাউদ্দিন? এ প্রশ্নেরও নিশ্চিত কোনো উত্তর নেই। উল্টো দেশসেরা স্থানীয় কোচের স্বীকৃতি পাওয়া সালাউদ্দিনের সমালোচনার বিস্ফোরণ শুরু হয়ে গেছে। তবে সবচেয়ে সংকটাপন্ন মনে হচ্ছে ফিল সিমন্সকে। নমনীয়তার কারণে বিসিবির সুনজরে তিনি আর নেই। তা ছাড়া ব্যর্থতার দায় কাউকে না কাউকে তো নিতে বা দিতে হবে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, ফিল সিমন্স প্রথাগত এই চর্চার সবচেয়ে সহজ শিকার!
এই দেখতে দেখতে প্র্যাকটিস শেষে হোটেলে ফেরেন জয়াসুরিয়া। হোটেলের নিরাপত্তাবলয় পেরিয়ে কাছে আসতেই হাসিমুখে সম্মতি দিলেন সাক্ষাৎকার গ্রহণের। দারুণ মুডে আছেন তিনি। পরের পর প্রশ্নের উত্তর দিয়ে গেছেন জয়াসুরিয়া। এর অংশবিশেষ শুনলে নিশ্চিতভাবেই মন ভালো হয়ে যেত মেহেদী হাসান মিরাজদের। ‘এমন ঘটনা প্রতিদিন ঘটে না। তবে এমন হতে পারে। আপনাকে শুধু নিশ্চিত করতে হবে, এমন কিছু যেন নিয়মিত না ঘটে। তাই আমি ভক্তদের অনুরোধ করব, তারা যেন এই ঘটনা নিয়ে দলের ওপর অপ্রয়োজনীয় চাপ সৃষ্টি না করে। আমাদের ক্ষেত্রে এসব ঘটেছে। ভারতের বিপক্ষে ক্যান্ডিতে একটা টুর্নামেন্টে জেতার জন্য শেষ ওভারে আমাদের মাত্র ৪ রান দরকার ছিল। কিন্তু আমরা পারিনি। সূর্যকুমার (যাদব) এসে উইকেটগুলো তুলে নিল। বিশ্বাস হয়? আবার এই অবস্থা থেকে খেলোয়াড়রা ঘুরে দাঁড়াবে। এটাই হয়। ওদের ওপর এই বিশ্বাস রাখুন। তবে এই ব্যর্থতা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হতে হবে। সেসব যেন গঠনমূলক হয়। আবারও বলছি, ক্রিকেটে এমন দিন আসে’—জয়াসুরিয়ার এই বিশ্বাসে আস্থা রাখার দায়ভার যাঁর যাঁর তাঁর তাঁর!
Post a Comment